আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: উত্তপ্ত সীমান্তের ওপার থেকে আসছে মর্টারশেল, নতুন করে পুশইনের শঙ্কা আর রাখাইন ঘিরে আন্তর্জাতিক রাজনীতি সব মিলিয়ে এক কঠিন সমীকরণে বাংলাদেশ। এমনটাই বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। সরকারকে বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেয়ার পাশাপাশি বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোড়ালোভাবে তুলে ধরারও তাগিদ তাদের।

মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ৩ দিনে মিয়ানমারের মোট ২৬৪ জন নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবন্দি নাকি শরণার্থী পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যদের কী হিসেবে বিবেচনা করছে বাংলাদেশ? প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা মাথায় নিয়ে চলা বাংলাদেশের সামনে তাই স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হয়েছে নতুন সংকট। রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হলেও একটি দেশের পালিয়ে আসা সামরিক সদস্যদের কীভাবে বিবেচনা করবে বাংলাদেশ।

আবার আরাকান কেন্দ্রীক ভূ-রাজনীতি ও কঠিন সমীকরণের সামনেও দেশ। এমন অবস্থায় নিজেদের জান্তা ফিরিয়ে নিতে কিংবা এমন পরিস্থিতিতে কোনো সাড়া মেলেনি নাইপেদো থেকে। উল্টো ঢাকাকেই দেখা যাচ্ছে তৎপর হতে। তবে এই সময়টাতে বুঝেশুনে পা ফেলার পরামর্শ নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের। আর বিষয়টি দ্রুত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নজরে আনতে আরও উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ তাদের।

এ বিষয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, মনে রাখতে হবে যে আরাকান আর্মির পেছনে যে শক্তি, সেটাকে বলা হয় চীন। এ ছাড়া আরাকান আর্মিকে মোটামুটি অপারেট করছে ভারতের কালাদান প্রজেক্ট। কাজেই একদিকে ভারত, একদিকে চীন, আর বার্মা অ্যাক্টের মাধ্যমে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই তিনটি শক্তির একটা বলয় তৈরি হয়েছে রাখাইন অঞ্চলে। কাজেই রণক্ষেত্র না হলেও বাংলাদেশ একটা বড় সমস্যার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। তাই পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেবে, সেটা সরকারকে বিবেচনা করতে হবে।

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির চলমান সংঘাতে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পালংখালী, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সাবরাং সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশিরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন। তারা বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন স্বজনদের বাড়ি ও আশপাশের গ্রামগুলোতে। তিন দিন ধরে আরকান আর্মির সঙ্গে এই গৃহযুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ছোড়া গুলি ও মর্টারশেল পড়ছে বাংলাদেশের ভেতরে। এ কারণে চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন সীমান্তের মানুষ। অবশ্য, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে।

ফলে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ২৪০ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক (ডিসি)। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত পরিদর্শনকালে জেলা প্রশাসক শাহ মুজাহিদ উদ্দিন এ নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, বান্দরবান-মিয়ানমার সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান পরিস্থিতির কারণে ছাত্রছাত্রী ও সীমান্তে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী ২৪০ পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সীমান্তবর্তী স্কুলগুলো বন্ধ ও সবাইকে আতঙ্কিত না হয়ে সজাগ থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়রা জানায়, সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। এরইমধ্যে সীমান্ত লাগোয়া দেশটির সরকারি বাহিনীর তমব্রু রাইট ক্যাম্প দখলে নিয়েছেন বিদ্রোহীরা। বর্তমানে ঢেকুবনিয়ে বিজিপি ক্যাম্প দখলে নিতে উভয় পক্ষের লড়াই চলছে। তাদের এ সংঘাতে ব্যবহার করা গুলি ও মর্টার শেলের গোলা সীমান্ত অতিক্রম করে এসে পড়ছে বাংলাদেশের ঘুমধুম এলাকার বিভিন্ন লোকালয়ে।

গত সোমবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জলপাইতলি এলাকায় এক বাংলাদেশি নারীসহ দুজন নিহত ও আহত হয়েছে অন্তত তিনজন। বিদ্রোহীদের কাছে টিকতে না পেরে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) ১১৩ সদস্য। এ অবস্থায় সীমান্তে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের নিরাপদে আশ্রয় দিতে উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সোমবার রাত থেকে ঘুমধুমের কোনাকপাড়া, জলপাইতলি ও ভাজাবনিয়া এলাকার বাসিন্দাদের ওই আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এদিকে মিয়ানমার থেকে ছোড়া গোলায় নাইক্ষ্যংছড়িতে সৈয়দ আলম (৩৮) নামের আরও এক বাংলাদেশি যুবক আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের পশ্চিমকুল পাহাড়পাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সৈয়দ আলম ওই এলাকার কাদের হোসেনের ছেলে।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার আনোয়ার হোসেন বলেন, গত রাত থেকে উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানীয়দের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। আহতের বিষয়টি শুনেছি। বিস্তারিত পরে জানা যাবে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার ওপারে মিয়ানমার সীমান্তে গত চার দিন ধরে থেমে থেমে মর্টারশেল ও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সর্বশেষ সোমবার রাতে গোলাগুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন উখিয়ার পালংখালী এবং টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সাবরাং ইউনিয়নের বাসিন্দারা।

পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন, হোয়াইক্যং ইউপির চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী, হ্ণীলা ইউপির চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, পালংখালী, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সাবরাং ইউনিয়নের নাফ নদীর বিপরীতে মিয়ানমার সীমান্ত। গত শনিবার থেকে বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে গোলাগুলি চলছে। সে দেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও দেশটির সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) লড়াই চলছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি গুলি ও মর্টারশেল বাংলাদেশে এসে পড়েছে। এতে অনেকে হতাহত হয়েছেন। এ অবস্থায় আমাদের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন।

পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন বলেন, বালুখালী, পালংখালী ও আনজুমানপাড়ার বিপরীতে মিয়ানমারের ঢেঁকিবনিয়া এলাকায় এখনও থেমে থেমে প্রচুর গোলাগুলি চলছে। আতঙ্কে আমাদের সীমান্তের বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। অনেকে আশপাশের এলাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

সীমান্তের একাধিক সূত্র বলছে, বান্দরবানের তুমব্রু, ঘুমধুম সীমান্তে রাখাইনে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তিনটি ক্যাম্প দখলে নিয়েছে বিদ্রোহী গ্রুপ আরকান আর্মি। মঙ্গলবার সকাল থেকে রাখাইনের ঢেকিবুনিয়া ক্যাম্পে অভিযান জোরদার করেছে তারা। বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়ার রহমতের বিল ও আন্জুমানপাড়া সীমান্তের ওপারে বিকট শব্দে গোলাগুলি চলছে।

এ অবস্থায় সীমান্তের বিদ্রোহী গ্রুপ আরকান আর্মির সঙ্গে গৃহযুদ্ধে টিকতে না পেরে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে এ পর্যন্ত ২২৯ জন বিজিপির সদস্য। তাদের অনেকে আহত হয়েছেন। বিজিবি সদর দফতরের গণসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলামের দেওয়া তথ্যমতে, মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান সংঘাতে সীমান্ত পার হয়ে সশস্ত্র অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ২২৯ বিজিপি সদস্যকে নিরস্ত্র করে বিজিবির হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঢেকিবুনিয়া এলাকার বিজিপি ২নং ব্যাটালিয়ন ক্যাম্পে এলাকা থেকে একটি মর্টারশেল এসে সীমান্তের এপারে দক্ষিণ ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে বেতবুনিয়া এলাকার একটি বাড়ির জানালায় আঘাত হেনেছে। সীমান্ত এলাকার আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন।

নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান এমকেএম জাহাঙ্গীর আজিজ জানিয়েছেন, খুব সকাল থেকে ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে ঢেকিবুনিয়া এলাকার মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে বিজিপির ২নং ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প এলাকায় তুমুল গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আনুমানিক সকাল ৯টার দিকে হঠাৎ একটি মর্টারশেল এসে ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনের এলাকার সৈয়দ নুর শিকদার নামে এক ব্যক্তির বসতঘরের একপাশে আঘাত করে। তবে কেউ হতাহত হয়নি।

উখিয়ার পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে সীমান্তের ওপারে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। হঠাৎ মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি মর্টারশেল উখিয়ার থাইংখালী রহমতের বিল সীমান্তের এক কিলোমিটার ভেতরে এসে পড়ে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সকালে ওপার থেকে কিছু অস্ত্রধারী লোক এপারে আশ্রয়ের জন্য প্রবেশ করেছে। তাদের বিজিবির হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।

লম্বাবিল সীমান্তের বাসিন্দা শফিউল আলম বলেন, ‘সীমান্তের তুমব্রু এলাকায় সপ্তাহজুড়ে যুদ্ধের গোলাগুলি, মর্টারশেল, গ্রেনেডের আওয়াজ শুনে আসছিলাম। এখন হয়তো সে দেশের সরকার আর বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধের স্থান পরিবর্তন হয়েছে।’

উখিয়ার ধামনখালী সীমান্তে বসবাসরত মোহাম্মদ আতিক বলেন, ‘সকাল থেকে তুমুল যুদ্ধ চলছে সীমান্তের ওপারে। সকাল ৯টার পর সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ বেশকিছু লোক অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের বিজিবি আটক করছে বলে শুনছি।’ এর আগে, সোমবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া একটি মর্টারশেল সীমান্তের ঘুমধুমে একটি বাড়িতে এসে পড়ে। এ ঘটনায় ওই এলাকার বাংলাদেশি এক নারীসহ দুজন নিহত হয়েছেন।

গত এক বছর ধরে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবানের মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির লড়াই চলছে। মাঝে কিছুদিন উত্তেজনা কমে আসলেও গত তিন দিন তুমুল লড়াই হচ্ছে। সীমান্তের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, মঙ্গলবার সকালে থাইংখালী রহমতের বিল সীমান্ত দিয়ে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বিজিপি ছাড়াও অর্ধশতাধিক মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাদের বিজিবি হেফাজতে নিয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রীয় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে জাতিগত বিদ্রোহীদের চলমান সংঘর্ষে জীবন বাঁচাতে এখন পর্যন্ত ২৬৪ জন বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। তাদের মধ্যে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্য, সেনা সদস্য, পুলিশ সদস্য, ইমিগ্রেশন সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন।

দেশটিতে সংঘাত চলাকালে গতকাল মঙ্গলবার নতুন করে ৬৫ জন রোহিঙ্গা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছিলেন। টেকনাফে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদের প্রতিহত করে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ২৬৪ জনের মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নতুন করে ৩৫ জন যুক্ত হয়েছেন। পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াদের মধ্যে বিজিপি সদস্য ১৮৩ জন, দুই সেনাসদস্য, চার সিআইডি, পাঁচ পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ৯ জন, ইমিগ্রেশন সদস্য ২০ জন ও বেসামরিক নাগরিক ৪ জন। নতুন আশ্রয় নেওয়া ৩৫ জনের পরিচয় শনাক্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

মঙ্গলবার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নবনিযুক্ত বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী এসব কথা জানান। তিনি বলেন, গত সোমবার দিনগত রাত পর্যন্ত ১১৫ জন মিয়ানমারের বিজিপি সদস্য, সেনাসদস্য আত্মসমর্পণ বা আমাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। আজ সকালে আরও ১১৪ জন যোগ হয়েছে। মোট ২২৯ জন আশ্রয় নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে দুপুরের মধ্যে আরও ৩৫ জন যোগ হয়ে ২৬৪ জনকে আমরা আশ্রয় দিয়েছি। তাদের থাকা ও খাবারের ব্যবস্থাও করেছি।

তিনি জানান, তাদের মধ্যে ১৫ জন আহত ছিলেন, ৮ জন ছিলেন গুরুতর আহত। গুরুতর আহত ৮ জনের মধ্যে চারজনকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে বিজিবির ব্যবস্থাপনায় ভর্তি করা হয়েছে। বাকি চারজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিজিবির ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের বিষয়ে মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, মঙ্গলবার সকালে ৬৫ জন রোহিঙ্গা নৌকায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছিল। সেখানে টেকনাফ বিজিবি তাদের প্রতিহত করে পুশব্যাক করার কার্যক্রম চলমান। কোনোভাবেই একজন রোহিঙ্গাকেও বাংলাদেশের ভেতরে আমরা ঢুকতে দেবো না। বিজিবি জানায়, সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত টহল ও চেকপোস্ট বাড়ানো হয়েছে। কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। দেশের স্বার্থে সীমান্তে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকবে বিজিবি।

বান্দরবান সীমান্তের বাসিন্দাদের জন্য খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র: মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জান্তা বাহিনী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। সীমান্ত এলাকায় এসে পড়ছে মর্টার শেল ও গোলা। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে বান্দরবান জেলা প্রশাসন। গতকাল মঙ্গলবার বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন সীমান্ত পরিদর্শনে এসে এসব কথা জানান।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক জানান, মিয়ানমারে চলমান সংঘর্ষের জেরে উত্তেজনা চলছে বাংলাদেশ সীমান্তে। তাই আমরা সীমান্ত এলাকার মানুষের জন্য ২টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছি। আমাদের আহ্বান সীমান্ত এলাকার মানুষজন যাতে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যান।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা হয়েছে যদি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় তাহলে সবাইকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাব। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের ফেরত পাঠানো বা পুশব্যাক করার জন্য কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশা করছি তাদের ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারব। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।

বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বলেন, বিজিবি, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও জেলা প্রশাসক একসঙ্গে কাজ করছি। বিজিবির কাছ থেকে যে ধরনের সহায়তা চাওয়া হচ্ছে আমরা তা করছি। আরও সহায়তা লাগলে করবো। পুলিশ সুপার আরও বলেন, আমরা সবচেয়ে বেশি জোর দিচ্ছি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে। এই এলাকার মানুষের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করেছি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

সীমান্তে উত্তেজনার মধ্যেও মাদক পাচার: মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জান্তা বাহিনী এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাতে সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতেও থেমে নেই মাদক চোরাকারবারি চক্র। গতকাল ভোর সাড়ে ৬টায় টেকনাফের খারাংখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৬৪ হাজার ৬০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে বিজিবি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ।

তিনি জানান, টেকনাফের খারাংখালী বিওপির দায়িত্বপূর্ণ বিআরএম-১৪ হতে আনুমানিক ৭০০ গজ দক্ষিণ দিকে হেলালের ঘের নামক এলাকা দিয়ে মাদকের একটি বড় চালান মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসতে পারে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে বিজিবি টহলদল একজন ব্যক্তিকে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসতে দেখে চ্যালেঞ্জ করলে একটি পোটলা ফেলে দৌড়ে পাশের গ্রামে পালিয়ে যায়। পরে তল্লাশি চালিয়ে চোরাকারবারির ফেলে যাওয়া পোটলাটি উদ্ধার করা হয়। যার ভিতর থেকে ৬৪ হাজার ৬০০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়।