আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নতুন সদস্যদের শপথ গ্রহণ শেষ হয়েছে। শেষ হয়েছে নতুন মন্ত্রিসভা গঠনও। নতুন করে গুঞ্জন শুরু হয়েছে, বাড়ছে মন্ত্রিসভার কলেবর। দ্বিতীয় দফায় কারা মন্ত্রিসভায় স্থান পাচ্ছেন, নতুন নাকি পুরাতন সদস্যরা সব মহলে চলছে এমন আলোচনা। তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন নেতাও।

তাদের মন্তব্য, শিগগিরই বাড়তে পারে মন্ত্রিসভার আকার। তবে বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত মন্ত্রিসভা শিগগিরই সম্প্রসারণ হতে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসন থেকে ফেব্রুয়ারির শেষদিকে মন্ত্রিসভায় যুক্ত হতে পারেন আরও ৯-১০ জন। নতুন করে কাদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে সে ব্যাপারে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। সংরক্ষিত নারী আসনের এমপিদের মধ্যে থেকে অন্তত এক থেকে দুজনকে মন্ত্রী করা হতে পারে।

নতুন মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছেন টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ৩৭ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভায় প্রথমবারের মতো যুক্ত হয়েছেন ১৪ জন। এই তালিকায় স্থান পাননি বিদায়ি মন্ত্রিসভার ২৮ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী। বাদ পড়াদের মধ্যে রয়েছেন ১৪ জন মন্ত্রী, ১২ জন প্রতিমন্ত্রী ও দুজন উপমন্ত্রী। বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন সময়ে বেফাঁস মন্তব্যসহ মন্ত্রণালয়ে অনুপস্থিতি, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, অবৈধ সম্পদ অর্জন, স্বজনপ্রীতি ও সফলতার সঙ্গে কাজ করতে না পারায় বাদ পড়েছেন কেউ কেউ।

এ ছাড়া নতুনদের জায়গা দিতে একাধিক মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীকেও বাদ দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিদায়ি মন্ত্রিসভার আকার ছিল ৪৮ সদস্যের। নতুন ৯ বা ১০ জন যুক্ত হলে বর্তমান মন্ত্রিসভার আকার দাঁড়াবে ৪৬ বা ৪৭ জনে।
নতুন করে কারা আসছেন মন্ত্রিসভায় এ নিয়ে দলের ভেতরে-বাইরে চলছে বিভিন্ন আলোচনা।

কর্মকর্তারা জানান, মন্ত্রিসভা গঠনের পুরোপুরি এখতিয়ার সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনি কাকে অন্তর্ভুক্ত করবেন এবং কাকে বাদ দেবেন সেটি তার এখতিয়ার। তবে মন্ত্রিসভায় বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে বেশিরভাগ নতুনদের স্থান দেওয়া এবং নবীন ও প্রবীণের সমন্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়টি ইতিবাচক। তারা বলেন, ১১ জানুয়ারি ৩৭ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পর থেকেই বোঝা গিয়েছিল বর্তমান মন্ত্রিসভা পূর্ণাঙ্গ নয়।

সরকার ও আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক সূত্র জানায়, মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ে নতুন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী দেওয়া হবে। এ ছাড়া আরও একাধিক মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হবে। সেগুলোতে জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের পাশাপাশি তরুণ প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে দক্ষতা ও তারুণ্যের সমন্বয় ঘটানো হবে। মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ হলে এতে একাধিক নারী যুক্ত হবেন।

বর্তমান মন্ত্রিসভার পরিধি বাড়ছে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটি প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন। তবে কিছু মন্ত্রণালয় যেমন- শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এগুলোতে কোনো না কোনো সময় মন্ত্রী আসবেন। সংরক্ষিত আসনে নির্বাচনের পর নারীদের মধ্যে থেকে মন্ত্রী আসতে পারেন।’ গত সোমবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের উত্তরে এসব কথা বলেন ওবায়দুল কাদের।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, মন্ত্রিসভায় ফেরার আলোচনায় রয়েছেন সাবেক চার নারী প্রতিমন্ত্রী। ওই চারজনের মধ্যে থেকে অন্তত দুজনের আবারও মন্ত্রিসভায় ফেরার সম্ভাবনা রয়েছে। এ চারজন হলেন সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। এছাড়া সংরক্ষিত আসনের এমপি আ’লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহম্মেদকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হচ্ছেন বলেন গুঞ্জন রয়েছে।

দলীয় একাধিক সূত্রমতে, সাবেক চার প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে তারানা হালিমের মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের সময়ে পরপর দুটি মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমে তিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। পরে তিনি তথ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারানা হালিম নবম ও দশম সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি এবার আবারও সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন।

আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, তারানা হালিম ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময়ে সরকারের প্রভাবশালী একটি অংশের সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। পরে খানিকটা অভিমান করেই সে সময়ে তিনি দলে নিস্কিয় হয়ে পড়েন। তবে গত বছর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য হওয়ার পর দলীয় কর্মকাণ্ডে নিয়মিত অংশ নিতে শুরু করেন। বর্তমানে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারানা হালিম সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ। তাকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানেরও মন্ত্রিসভায় ফেরার গুঞ্জন রয়েছে। তিনি খুলনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। মন্নুজান সুফিয়ান ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। বিগত জাতীয় নির্বাচনে তিনি দলের মনোনয়ন পাননি। গত বুধবার তাকে সংরক্ষিত আসনের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একটি সূত্র জানায়, অতীত অবদানের কারণে মন্নুজান সুফিয়ানের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের। মন্নুজানের স্বামী আবু সুফিয়ান বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আবু সুফিয়ান খুলনার খালিশপুরে শ্রমিক নেতা হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৭২ সালে খালিশপুরেই দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে আবু সুফিয়ানকে। এরপর সেখানে শ্রমিক সংগঠনগুলোকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মন্নুজান সুফিয়ান। তিনি ১৯৮৩ সাল থেকে একাধিক মেয়াদে আওয়ামী লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। দুর্দিনের নেতা হিসেবে মন্নুজানকে আবারও মন্ত্রিসভায় দেখা যেতে পারে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক দুই প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা ও মেহের আফরোজ চুমকিরও মন্ত্রিসভায় ফেরার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি ২০১৩ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। আর ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা সরকারের বিগত মেয়াদে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নারী নেত্রীও প্রতিমন্ত্রী হওয়ার আলোচনায় আছেন। দলের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক রোকেয়া সুলতানা, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, কার্যনির্বাহী সদস্য সানজিদা খানমের নাম দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীর মাঝে আলোচনায় রয়েছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর একাধিক নেতা জানান, সংরক্ষিত আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা আজ রবিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হবে। সংরক্ষিত আসনের নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ নেবেন। এর কয়েক দিনের মধ্যেই মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত আসতে পারে।