সাইফুল ইসলাম, দেশ প্রতিক্ষণ, মালয়েশিয়া: সর্বশেষ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে অনিয়মের অভিযোগে স্থগিত করে দেয়া হয় কলিং ভিসার কার্যক্রম। তার পর চলে দীর্ঘ সময় দুই দেশের সরকারের উচ্চপর্যায়ের নানা দেনদরবার। দেনদরবার করে ২০২২ এ চালু হলো সেই অধীর আকাক্সিক্ষত কলিং ভিসায় মালয়েশিয়া শ্রমিক প্রেরণ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী কর্মীর প্রচুর চাহিদার ভিত্তিতে জনশক্তি পাঠানো শুরুর পর এখন পর্যন্ত লক্ষাধিক কর্মী মালয়েশিয়া পৌঁছেছেন। আরো লক্ষাধিক বাংলাদেশী কর্মী মালয়েশিয়ায় যাওয়ার অপেক্ষায় পাইপলাইনে আছে বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।

এরই মধ্যে প্রতিদিন অসংখ্য কর্মী অভিযোগ করছেন তারা চুক্তি অনুযায়ী কাজ পাচ্ছে না। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন চার-পাঁচ মাস হয়ে গেলেও তাদেরকে কাজ দিচ্ছেন না নিয়োগকর্তারা। আবার অনেকে কোম্পানি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। শত শত শ্রমিক কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে মিডিয়া ও দূতাবাসে অভিযোগ আসছে।

তবে বেশির ভাগ কলিং ভিসার কর্মী বলছেন, চুক্তি অনুযায়ী তারা কাজ পেয়েছেন বা এখন কাজ করছেন। বেতনভাতাদি পেতে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আবার কিছু কিছু কর্মী অভিযোগ করছেন তারা মাসের পর মাস বসে আছেন কিন্তু মালিক তাদের কাজ দিচ্ছেন না বা থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন না। তাদের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে দেখা যায়, প্রাথমিকভাবে সত্যতা পাওয়া গেলেও সেখানে মালিকপক্ষের কাউকে না পাওয়ায় তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

তবে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় গিয়েও কাজ না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশি কর্মীরা। অন্যদিকে, বিনা খরচের নামে মালয়েশিয়ায় পাঠানো হচ্ছে কর্মীদের। রিক্রুটিং এজেন্সির নেতারা বলছেন, কর্মীদের কাজ না পাওয়ার দায় দূতাবাসের। আর অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এই পরিস্থিতিতে অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, সরকারের উদাসীনতাই এর জন্য দায়ী।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ‘কলিং ভিসায়’ মালয়েশিয়ায় গেছেন প্রায় ৪ লাখ কর্মী। সম্প্রতি বিদেশে ভালো কাজের আশায় এশিয়ার দেশটিতে পাড়ি জমানো বাংলাদেশিদের একজন বলেন, আমরা মালয়েশিয়া এসেছি তিন মাসের বেশি হবে। চতুর্থ মাস চলছে। আমরা খুব নির্যাতিত ভাবে আছি।

এই কর্মীর মতো একই অবস্থা আরও অনেক প্রবাসীর। ‘কলিং ভিসায়’ মালয়েশিয়ায় গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। সরকারি নথিতে মাত্র ৭৮ হাজার টাকা লেখা থাকলেও, একেকজনের খরচ হয়েছে চার থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকা। এরমধ্যেই বিনা খরচে সরকারিভাবে দেশটিতে পাঠানো হচ্ছে আরও কর্মী।

বিদেশে কাজের আশায় রিক্রুটিং এজেন্সি ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনালে আসা একজন বলেন, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে মালয়েশিয়ান কোম্পানি ‘ন্যাশনগেটস্ সলিউশন’ বিনা খরচে কিছু লোক নেবে। তাই এসেছি। আরেকজন বলেন, ডেলিগেটের কাছে ভাইভা পরীক্ষা দিয়েছি। পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হই। এরপর তারা (রিক্রুটিং এজেন্সি) আমাকে আবার ডাকেন মেডিকেল করার জন্য। আমি মেডিকেল করি, তারপর ‘কলিং ভিসা’ আসে। মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ কেমন হবে তা জানিয়ে অপর একজন বলেন, আমাদের ওখানে যাওয়ার পর তারা (ন্যাশনগেটস্ সলিউশন) আমাদের ট্রেনিং দেবে। এরপর তারা যে যেই কাজ ভালো করতে পারবে তাকে সেই কাজ দেবে।

চুক্তিপত্র থাকার পরও কেন কাজ মিলছে না, কাজ না পাওয়ার দায় কেন নিচ্ছে না মালয়েশিয়ার নিয়োগকর্তারা- এসব প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) অভিযোগের তির, দূতাবাস ও সরকারের দিকে। বছরের পর বছর ধরে মালয়েশিয়া প্রবাসীদের দুর্দশার একই চিত্র বারবার উঠে এলেও নির্বিকার তারা। বায়রা মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, কাজ না পাওয়া, কোম্পানির যে অ্যাড্রেস (ঠিকানা) নেই- এটার সত্যায়ন কে করছে, এটা তো দূতাবাস করছে।

তবে সমস্যা সমাধানে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নতুন প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরীর দাবি, এসবের ব্যাপারে আমাদের মন্ত্রণালয়ে যারা অ্যাম্বাসির লেবার মিনিস্ট্রিতে আছে, তারা কাজ করছে। তদন্ত করছে। তারা সঠিক তদন্তের মাধ্যমেই আমাদের পাস দেবে এবং দিচ্ছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসী শ্রমিকদের দুর্দশার দায় এড়াতে পারে না সরকার। বিদেশের শ্রমবাজার নিয়ে সরকারের আরও সমন্বিতভাবে কাজ করা দরকার। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির বলেন, শ্রমবাজার নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করা সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। সে ক্ষেত্রে দরকার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলা।

নামেমাত্র কিছু কোম্পানি রয়েছে তাদের উদ্দেশ্য হলো কলকারখানা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা নয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য সরকারকে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে কলিং ভিসায় হাজার হাজার শ্রমিক আমদানি করার জন্য লাইসেন্স ও অন্যান্য অনুমোদন নেয়া। অনুমোদন নিয়ে বাংলাদেশ কিংবা অন্যান্য সোর্স কান্ট্রি থেকে শ্রমিক আমদানি করে প্রত্যেক শ্রমিক থেকে লাখ লাখ টাকা নগদ আয় করে। এটিই তাদের নগদ লাভ।

কারণ একজন শ্রমিক মালয়েশিয়ায় পৌঁছানো সব খরচসহ এক লাখ টাকাই যথেষ্ট। তা হলে প্রশ্ন হলো বাকি টাকা কোথায় যায়? এর কথা কেউ জানেন না, আর যারা জানেন তারা কেউ বলেন না। মালয়েশিয়ায় নিয়ে এসে তাদের তৎক্ষণাৎ কাজ দিতে পারে না। কারণ তার তো বাস্তবে কোনো কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান নেই।

তখন বিভিন্ন মহলের চাপ সামলাতে বেকার শ্রমিকদের বিভিন্ন কোম্পানিতে বিক্রি করে দেয়া হয়। যারা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে মানিয়ে কাজ করতে পারেন তারাই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারেন। আর বেশির ভাগের কপালে জোটে অবৈধ শ্রমিকের তকমা তার পর জেলজরিমানায় নিঃস্ব হওয়ার পরিণতি।