আলমগীর হোসেন ও আবদুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা রাজধানীর এক হাজার ৮১৮টি ভবনের ব্যাপারে কোনো ফয়সালা হয়নি। গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে লালফিতায় বন্দী এসব বহুতল ভবনের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউক অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকা রাজধানীর নকশা লঙ্ঘন করে নির্মিত ১ হাজার ৮১৮টি বহুতল ভবনের তালিকা তৈরি করে।

কিন্তু তালিকা পর্যন্তই সব কাজ শেষ শেষ। এসব ভবনকে ঝুঁকিমুক্ত করা কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ অংশ ভেঙে ফেলার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি গত ৫ বছরে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর গুলশানে বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বরং গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় হতভম্ব রাজধানীবাসী। ফলে বেইলি রোডের অগ্নিকান্ডের পর ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনের বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৯ সালে মার্চ মাসে এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাই নড়েচড়ে বসে। শুরু হয় রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সানক্তের কার্যক্রম। দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে গুলশান, বনানীন, ধানমন্ডি, মতিঝিল এলাকায় বহুতল ভবন যেগুলো নকশা বহির্ভূতভাবে তৈরি করা হয়েছে তার একটা দীর্ঘ তালিকা তৈরি করে।

যেখানে স্থান পায় ১ হাজার ৮১৮টি বহুতল ভবন। কিন্তু এই তালিকা প্রকাশ কিংবা তালিকা ধরে ভবনগুলোর মালিকদের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা গত ৫ বছরেও নিতে পারেনি রাজউক কিংবা সরকারের অন্য কোনো সংস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, প্রভাবশালীদের চাপের মুখে এই তালিকা প্রকাশই করতে পারেনি রাজউক।

এদিকে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের ৭ তলা ভবন গ্রিন কোজি কটেজে আগুন লেগে ৪৬ জন মারা গেছেন। তারপর গত শুক্রবার ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রাজউক। তদন্ত কমিটিকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০০৬ সালে কেটিএস গার্মেন্টে আগুন লেগে ৬৫ জন, ২০১০ সালে নিমতলী রাসায়নিক গোডাউনের আগুনে ১২৪ জন, ২০১২ সালে তাজরিন কারখানায় আগুনে ১৫০ জন, ২০১৯ সালে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লেগে ২৬ জন, ২০২১ সালে নারায়ণগঞ্জের সজীব গ্রুপের ভবনে ৫২ জন আগুনে পুড়ে মারা যান। এসব ঘটনায় ভবন নির্মাণে অনিয়ম পেলেও মালিক বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান কারোরই তেমন কোনো বিচার হয়নি।

২০১৯ সালের মার্চে বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগে। ভবনটির অনুমোদন ছিল ১৮ তলার। কিন্তু বেআইনিভাবে করা হয়েছিল ২২ তলা। এ ছাড়া ভবনটিতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন প্রাণ হারান। আহত হন ৭৩ জন। কিন্তু মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এফআর টাওয়ারের অতিরিক্ত চারতলাও ভেঙে ফেলা হয়নি। আবার সবকিছু আগের মতোই চলছে।

এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডের পর নড়েচড়ে বসে রাজউক। ফায়ার সার্ভিসকে সঙ্গে নিয়ে নগরীর বিভিন্ন ভবনে অভিযান চালানোর পাশাপাশি ১৮১৮টি ভবনের তালিকা করা হয়। তারপর ৬ বছর পার হলেও তালিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এর আগেও ৩ হাজার ভবনের ১টি ও ৫ হাজার ভবনের ১টি তালিকা করেছিল রাজউক। সেই তালিকা অনুযায়ীও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই তালিকা দুটিই ছিল নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মাণ করা ভবনের।

এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর তৎকালীন গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছিলেন, ১৫ দিনের মধ্যে অগ্নি-ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনের তালিকা প্রকাশ করা হবে। তারপর মন্ত্রীর দপ্তর বদল হয়ে যায়। তাকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে একজন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই ঘটনার ৬ বছর পর শ ম রেজাউল করিম মুখ খুলেছেন। গত শনিবার সংসদে তিনি বলেন, আমরা সে সময় ১ হাজার ৩০০ ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করেছিলাম। কারণ ওই সব ভবন মন্ত্রণালয় অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী তৈরি করা হয়নি। কিন্তু সে ভবনগুলো ভাঙা সম্ভব হয়নি।

আরও কঠিন পদক্ষেপ দরকার মন্তব্য করে সাবেক মন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার হাতে দায়মুক্তির সংস্কৃতি ধ্বংস হয়েছে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বড় বড় অপরাধীর বিচার হয়েছে। সে ক্ষেত্রে দায়মুক্তির সংস্কৃতি থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় আরও কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। শ ম রেজাউল করিম ১ হাজার ৩০০ ভবনের কথা বললেও আসলে তখন ১৮১৮টি বহুতল ভবনের তালিকা তৈরি করা হয়। ব্যবস্থা নেওয়া তো সম্ভব হয়ইনি, এমনকি সেই তালিকাও প্রকাশ করা হয়নি।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর রাজউকের করা এই তালিকা প্রকাশ করার ব্যাপারে সরকারের সদিচ্ছা ছিল। কিন্তু ভবনগুলোর মালিক এমন সব ব্যক্তি, যারা সমাজে খুবই প্রভাবশালী। এ কারণে মূলত তালিকা হিমঘরে চলে গেছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, এই ভবনগুলো যাদের তারা এতই প্রভাবশালী যে, রাষ্ট্র ও সমাজ চালান তারা। তারা মন্ত্রীকেও পরিবর্তন করে দিতে পারেন। এ কারণে এই তালিকা প্রকাশ করা যায়নি বলে মনে করি।