আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: অভ্যন্তরীণ বিরোধ কমাতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দেওয়ার অবস্থানেই রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু এই কৌশলের কারণে ভোটের অনেক আগে গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের বিভেদ প্রকাশ্যে এসেছে। কোনো কোনো জায়গায় সংঘাতও হয়েছে।

উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়ার খোকসায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতার বিরুদ্ধে দলেরই আরেক নেতাকে তুলে নিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দলটির নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না দেওয়া এবং প্রার্থী মনোনয়নে দলের কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ না রাখার কৌশলে তৃণমূলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘাত আরও বাড়তে পারে।

মুলত চার ধাপে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৫২ উপজেলায় ভোট হবে আগামী ৮ মে। জামানতের টাকা বাড়িয়ে এবং স্বতন্ত্রদের প্রার্থিতা সহজ করে বিধি সংশোধনের পর গত বৃহস্পতিবার কমিশন সভায় উপজেলা নির্বাচনের তফসিল চূড়ান্ত করা হয়। অভ্যন্তরীণ বিরোধ কমাতে এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দেয়ার অবস্থানেই রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ কৌশলের মাঝেও গত ফেব্রুয়ারি থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের বিভেদ প্রকাশ্যে এসেছে। কোনো কোনো জায়গায় সংঘাতও হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় এক নেতা জানান, প্রার্থী মনোনয়নে দলের কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। কিন্তু কোনো সংঘাত যাতে না হয়, সেজন্য ঈদের পরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের বৈঠক করা হবে। সেই বৈঠক থেকে দলের স্বতন্ত্র সব প্রার্থীর জন্য কিছু নির্দেশনা দেয়া হতে পারে।

জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র কৌশলের কারণে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, এখন উপজেলা নির্বাচনে দলীয়ভাবে মনোনয়ন না দেয়ার পেছনে সেই বিভেদ কমানোই প্রধান লক্ষ্য বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু কোনো উপজেলায় যখন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের বেশ কয়েকজন প্রার্থী হবেন, তখন সেখানে দলীয় নির্দেশনা কতটা মানা হবে, সেই প্রশ্নও রয়েছে দলটিতে।

এ ছাড়া দল কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো হস্তক্ষেপ না করায় প্রশাসন নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে বলে দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলছেন। কিন্তু মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অনেকে তাদের নিজেদের এলাকায় পছন্দের প্রার্থীর পক্ষ নিচ্ছেন বলে এখনই নানা অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে আসছে। এমন পটভূমিতে প্রশাসন কতটা নিরপেক্ষ ভূমিকা নেবে, সেই প্রশ্নও উঠছে দলটির তৃণমূলে।

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে ভোটার উপস্থিতি দেখাতে দলীয় প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কৌশল নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু তৃণমূলে তৈরি হয়েছে বিভক্তি এবং অনেক জায়গায় সংসদ সদস্য ও তাদের পাল্টা পক্ষ দাঁড়িয়ে গেছে। সেই বিভেদের জেরে এখনো কোনো কোনো জায়গায় সংঘাতের ঘটনাও ঘটছে।

১৬ মার্চ বরিশালের হিজলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতাকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেখানে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে দলের বিভেদের জেরে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আওয়ামী লীগের এই কৌশলের কারণে বিএনপিসহ অন্যান্য দলও স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, এটিও চাইছেন ক্ষমতাসীনরা।

একই সঙ্গে দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন, রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রে এখনো ভোটারদের আস্থার ঘাটতি রয়েছে বলে তারা মনে করেন। সে কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করা এবং ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়টিও উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দলটির কৌশলের ক্ষেত্রে অন্যতম একটি কারণ। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের এই কৌশলের কারণে বিএনপিসহ অন্যান্য দলও স্বতন্ত্র প্রার্থী দিয়ে এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, এটিও চাইছেন ক্ষমতাসীনরা।

এরই মধ্যে ৯ মার্চ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন ও কুমিল্লা সিটিতে মেয়র পদে একই কৌশলে নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগ। এই দুই সিটির নির্বাচন ঘিরে দলটির স্থানীয় নেতৃত্বের বিরোধ বেড়েছে। সেই উদাহরণও সামনে আসছে বলে দলটির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন। এমন পটভূমিতেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছেন, উপজেলা নির্বাচনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তবে তৃণমূলের বিভেদের কারণে নানা আশঙ্কা নিয়েও দলটির ভিতরে আলোচনা রয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, স্বতন্ত্র কৌশলের কারণে জাতীয় নির্বাচনেও সংঘাত সেভাবে হয়নি বলে তারা মনে করেন। এখন উপজেলা নির্বাচনেও শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের সংঘাত হবে না বলে তারা বিশ্বাস করেন। দলটির পক্ষ থেকে এও বলা হচ্ছে যে তৃণমূলে যারা সংঘাত-সহিংসতা করবে, তারা যে পর্যায়ের নেতা হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে দল কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বার্তাও দেবে।

দলটির অন্য একাধিক সূত্র অবশ্য বলছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে বিভেদ তৃণমূলে রয়েছে, সেই নির্বাচনের অল্প সময়ের ব্যবধানে উপজেলা নির্বাচনে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ না থাকলে সংসদ সদস্য ও পাল্টা পক্ষের বিভেদ আরও বাড়বে। এ নিয়েও দলে আলোচনা রয়েছে।

কারণ নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলায় ৮ মে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। এর আগেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভেদ মাথাচাড়া দিয়েছে। আর তফসিল ঘোষণার দিনই কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায় এক নেতার বিরুদ্ধে আরেক নেতাকে তুলে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ আলোচনায় এসেছে। এদিন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেনকে তুলে নিয়ে ঘরে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সদর খান তার নিজ বাড়িতে এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আলমগীর হোসেনকে তুলে নেয়ার তিন মিনিটের একটি ভিডিও কয়েকটি গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। এ ব্যাপারে সদর খানকে প্রধান আসামি করে খোকসা থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই আওয়ামী লীগ নেতা। এই অভিযোগে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে বিভেদের কথা বলা হয়েছে।

কুষ্টিয়া আওয়ামী লীগের এই দুই নেতার একজন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে এবং আরেকজন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ছিলেন। তাদের সেই বিভেদ এখন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাথাচাড়া দিয়েছে।

অন্যদিকে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেয়া না হলেও দেশের কোনো উপজেলায় সংসদ সদস্য ও স্থানীয়ভাবে দল থেকে একক প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্তও নেয়া হচ্ছে। পাল্টা পক্ষও সক্রিয় রয়েছে। এমন পটভূমিতেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছেন, উপজেলা নির্বাচনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তবে তৃণমূলের বিভেদের কারণে নানা আশঙ্কা নিয়েও দলটির ভিতরে আলোচনা রয়েছে।

উল্লেখ্য, ৮ মে প্রথম ধাপের পর ২৩ ও ২৯ মে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ এবং ৫ জুন শেষ ধাপের ভোট হবে। এসব উপজেলায় চেয়ারম্যান, সাধারণ ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত ভাইস চেয়ারম্যান পদে হবে সাধারণ নির্বাচন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী প্রথম ধাপে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া যাবে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১৭ এপ্রিল, প্রত্যাহারের শেষ সময় ২২ এপ্রিল।

ভোট হবে ৮ মে। প্রথম ধাপের ১৫২ উপজেলার মধ্যে ২২ উপজেলায় ভোট হবে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে; বাকিগুলোতে ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ হবে। সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত একটানা এ ভোট চলবে। উপজেলার ভোটে রিটার্নিং কর্মকর্তা হবেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা হবেন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা।

নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে নির্বাচন পরিচালনা বিধি ও আচরণবিধি সংশোধন করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ সহজ করেছে। এতদিন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের যে তালিকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হতো, এবার তা দিতে হবে না। সেই সঙ্গে সাদাকালোর সঙ্গে রঙিন পোস্টারও ছাপাতে পারবেন প্রার্থীরা। ভোটের প্রচারের সময়ও পাচ্ছেন বেশি। তবে জামানতের পরিমাণ বেড়েছে এবার।

চেয়ারম্যান পদে জামানতের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লাখ টাকা করা হয়েছে। ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামানত পাঁচ হাজার টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। প্রতীক বরাদ্দের পর প্রচার হবে। তবে তার আগে অনলাইনে এবং পাঁচজন মিলে প্রচার করতে পারবে। দেশে এখন ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে। চার ধাপে নির্বাচন উপযোগী ৪৮৫টির ভোট হবে, পরে মেয়াদোত্তীর্ণ হলে বাকিগুলোয় ভোট হবে।