আবদুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রমজান মাস যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নানা ধরনের খেজুরের দাম। কিছুদিন আগেও যে খেজুর কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছিল হাজার টাকার মধ্যে, মাস দুয়েকের ব্যবধানে এখন তা প্রায় আড়াই হাজার টাকায় উঠেছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, তাই বিক্রিও করতে হচ্ছে বেশি দামেই।

অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্ক বিভাগের অধিকমাত্রায় করারোপে বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। ফলে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের টানাহেঁচড়ায় অস্থিরতার ফাঁদে পড়েছে বাজার, যার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের।

মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে জাহিদি খেজুর। এ খেজুরের প্রতি কেজির দাম ২৫০ টাকা। অন্যদিকে দাব্বাস খেজুর ৪৫০ টাকা, লুলু ৫০০, মাশরুক সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ এবং মরিয়ম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়। কারওয়ানবাজারের খেজুর ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন কিছুটা ক্ষোভের স্বরে বলেন, গত বছর যে খেজুর ছিল ১৬০ টাকা, এবার সেই খেজুর ৩০০ টাকা ছাড়িয়েছে। কিছু কিছু খেজুরের দাম বেড়েছে দুই থেকে তিনগুণ। বড়লোক ছাড়া এখন কেউ আর খেজুর কেনেন না।

আরেক খুচরা ব্যবসায়ী মো. নোমান বলেন, ‘তিউনিশিয়ান খেজুর দুই মাস আগেও বিক্রি করেছি ১ হাজার ৩০০ টাকায়। এখন সেই খেজুর বিক্রি করতে হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকা। পাকিস্তানের খুরমা খেজুর ছিল ১৬০ টাকা, তা এখন ৩০০ টাকা। আবার মিসরের মেজডুল খেজুর ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, এখন সেটা ১ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।

আমরা কী করব, আমরা যে দামে কিনছি সব খরচ বাদ দিয়ে সামান্য কিছু মুনাফা রেখে বিক্রি করছি। দাম বাড়ানোর এসব কাজ করেন বাদামতলীর ব্যবসায়ীরা।’ বিষয়টির অনুসন্ধানের জন্য রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি ফলবাজার বাদামতলীতে গেলে সোমবার দেখা যায়, এখানে বস্তা খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজি। এছাড়া মানভেদে দাব্বাস খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৩৮০-৪২০ টাকা, বারনী ৩০৫, খালাস ৩৩৫, নাগাল ৩১৫, ছায়ের ২৯৫, জাহিদি ২৫৫ এবং রেজিজ মানভেদে ৩২০-৩৬০ টাকা।

দামের হঠাৎ এ বৃদ্ধি সম্পর্কে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, গত বছর যে খেজুর ছিল ১ হাজার ২৫০ টাকা, সেটি এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকায়। এ বাড়তি দাম হলো কাস্টমসের ডিউটি। দুই মাসের ব্যবধানে কাস্টমস ডিউটি কীভাবে বাড়ল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছর ৫ কেজির খেজুরে আমরা ডিউটি (শুল্ক) দিয়েছি ৫০ টাকা, এবার সেই ডিউটি দিতে হচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকা। অর্থাৎ কেজিতে ২১০ টাকা বেড়েছে শুল্ক। তিনি বলেন, যে খেজুর পাইকারি বাজারে ৪০০ টাকায় বিক্রি করছি সেটার জন্য শুধু ট্যাক্সই (কর) দিতে হচ্ছে ২১৮ টাকা। এছাড়া অন্য খরচ তো রয়েছেই।

চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘খেজুর আমদানিতে ১০ শতাংশ কর ছাড় দিলেও অন্যান্য শুল্ক আগের মতোই আছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সামান্য এ শুল্ক কমানোর প্রভাব খেজুরের দামে পড়ছে না।’ তবে বিশ্লেষকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, গত বছরের চেয়ে বর্তমানে দেশের বাজারে খেজুরের দাম বেড়েছে ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ। অথচ গত বছর শুল্ক, কাস্টমস ডিউটি, রেগুলেটরি ডিউটি, ভ্যাট, অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম কর মিলিয়ে ৫৩ শতাংশ আমদানি বাবদ রাজস্ব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এখন সেটি ১০ শতাংশ কমে ৪৩ শতাংশ হয়েছে। ফলে বড় ব্যবসায়ীরা সুবিধা পেলেও খুচরা ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা থাকছেন সুবিধাবঞ্চিত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘শুল্ক কমানোর পর ব্যবসায়ীরা বন্দর থেকে দ্রুতই খেজুর খালাস শুরু করেছেন। কিন্তু এরপরও কম দামে খেজুর কিনতে পারছেন না ভোক্তারা। শুল্ক কমানো ও পর্যাপ্ত আমদানি সত্ত্বেও খেজুরের দাম কেন কমছে না, তা তদারকি করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ডলার রেটের ঊর্ধ্বগতি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ থেকেই শুরু হয়েছে। ইদানীং বরং কিছুটা কমে এসেছে। ফলে ডলার রেটের যে কথা ব্যবসায়ীরা বলছেন, তা মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়।

এছাড়া কাস্টমসের ভ্যাট-ট্যাক্সও দুই মাস আগে বাড়েনি। অর্থবছরের শুরুতেই এগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। তাহলে দুই মাসের আগে যে খেজুরের দাম ১ হাজার ২০০ টাকা ছিল, সেটা এখন কেন ২ হাজার ২০০ টাকা, সেটা সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে। এ দাম বৃদ্ধির বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেও উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, রাজস্ব বোর্ড ঘোষণা দিয়েছে ১০ শতাংশ কর হ্রাস করা হয়েছে। কিন্তু এতে কত টাকা কমবে সেটা পরিষ্কার করেনি। ফলে এ ধোঁয়াশার সুযোগ নিচ্ছেন সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা।